চট্টগ্রামের দুর্গাপূজা মঞ্চে ইসলামি সংগীত পরিবেশনের ঘটনায় মামলা
চট্টগ্রামের জে এম সেন হলের দুর্গাপূজা মঞ্চে ইসলামি সংগীত পরিবেশনের ঘটনায় চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমির ছয় সদস্যসহ সাতজনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার এই বিতর্কিত ঘটনার পর পূজামণ্ডপে উপস্থিত হিন্দু ধর্মালম্বীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সমালোচনা জন্ম দেয়।
বিতর্কের সূত্রপাত
চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমির ছয়জন সদস্য, যাদের মধ্যে শহীদুল করিম, নুরুল ইসলাম, আবদুল্লাহ ইকবালসহ আরও কয়েকজন ছিলেন, তারা দুর্গাপূজার মঞ্চে ইসলামি গান পরিবেশন করেন। প্রথমে ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান’ গান পরিবেশন করে। এরপরে ‘শুধু মুসলমানের লাগি’ শিরোনামের একটি গান পরিবেশিত হয়। গানটি ইসলামী ছাত্রশিবিরের সহযোগী হিসেবে পরিচিত পাঞ্জেরি শিল্পী গোষ্ঠীর ওয়েবসাইটে ‘শুধু মুসলমানের লাগি’ শিরোনাম হিসেবে দেওয়া রয়েছে।
গানের যে কয়েকটি লাইন ভিডিওতে শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল সেগুলো ছিল ‘এসো সেই ইসলাম বুঝি, সত্য ন্যায়ের পথ খুঁজি, বিশ্ব মানুষের মুক্তির শেষ পথ, বিপ্লব ইসলামী বিপ্লব।’ গানটির গীতিকার ও সুরকার চৌধুরী আবদুল হালিম।
চট্টগ্রাম নগর (উত্তর) ছাত্রশিবিরের সভাপতি ফখরুল ইসলাম কাছে চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমি সম্পর্কে জানতে চাইলে জানান, এটি ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো সংগঠন নয়। তবে জামায়াতে ইসলামীর একজন নেতা প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন যে চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমি আসলে জামায়াত সমর্থিত একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন।
গতকাল চট্টগ্রামের জে এম সেন হলের দুর্গাপূজার মহাসপ্তমীর অনুষ্ঠানে সন্ধ্যায় পূজা উদ্যাপন পরিষদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে নাচের অনুষ্ঠান চলাকালীন কয়েকজন তরুণ মঞ্চে ওঠেন এবং তাঁরা দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করবেন বলে জানান। তাঁরা দুটি গান পরিবেশন করেন এবং পরে ধন্যবাদ জানিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে চলে যান।
এই ঘটনার বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদ্যাপন পরিষদের অর্থ সম্পাদক সুকান্ত মহাজন বলেন, পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক সজল দত্তকে ওই তরুণেরা মঞ্চে গান পরিবেশনার অনুমতি চেয়েছিলেন। অনুমতি পাওয়ার পর তাঁরা গান পরিবেশন করেন এবং অনুষ্ঠান শেষ করে চলে যান। সজল দত্তের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতে চেষ্টা করা হলেও তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
মঞ্চে গানের শুরুতে উপস্থিত সনাতন ধর্মালম্বীরা চমকে যান এবং পরে এই গান পরিবেশন বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপ
এই ঘটনায় উত্তেজনা বাড়ার পরপরই চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম পূজামণ্ডপে উপস্থিত হন এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। তিনি জানান, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
মামলার তথ্য ও গ্রেপ্তার
দুর্গাপূজা মঞ্চে ইসলামি সংগীত গাওয়ার ঘটনায় চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন কমিটির অর্থ সম্পাদক সুকান্ত বিকাশ মহাজন কোতোয়ালি থানায় সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, গানের শব্দচয়নের মাধ্যমে সনাতন ধর্মালম্বীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া হয়েছে, যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের শঙ্কা তৈরি করেছে।
এরই মধ্যে দুজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, তারা হলেন তানজিমুল উম্মাহ মাদ্রাসার শিক্ষক শহীদুল করিম এবং দারুল ইরফান একাডেমির শিক্ষক নুরুল ইসলাম। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা
এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা দেখা যায়। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, কীভাবে পূজামণ্ডপের মতো একটি ধর্মীয় স্থানে ইসলামি গান গাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর সনাতন ধর্মালম্বীদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা ও ক্ষোভ দেখা দেয়।
পূজা উদযাপন পরিষদের প্রতিক্রিয়া
চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি আশীষ ভট্টাচার্য জানান, এই ঘটনা কমিটির সদস্যদের অজান্তে ঘটেছে এবং সজল দত্তের অনুমতি ছাড়া তা সম্ভব হতো না। বর্তমানে তদন্ত চলছে, এবং পূজা উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে ওই যুগ্ম সম্পাদককে বহিষ্কার করা হয়েছে।
প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং বলেছেন, এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে আর যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করা হবে। দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ হিসাবে বাংলাদেশকে রাখতে প্রশাসন সক্রিয়ভাবে কাজ করবে।